‘ইধার সো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার’ অর্থাৎ এখানে ঘুমিয়ে আছে এক বিশ^াসঘাতক। পাকিস্তানের করাচির মাসরুর বিমান ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে নিতান্তই অযতœ আর অবহেলায় ফেলে রাখা বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের কবরের সামনে লেখা ছিল এই কথাটি। পাকিস্তানের চোখে তিনি গাদ্দার কিংবা বিশ^াসঘাতক হলেও বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন তিনি। অসীম সাহস নিয়ে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য বিমান ছিনতাই করে আনতে গিয়ে যিনি শহীদ হয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ৩৫ বছর পর, ২০০৬ সালের ২৪ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এরপর ২৫ জুন পূর্ণ মর্যাদায় শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পুণঃরায় দাফন করা হয় এই সূর্যসন্তানকে। মতিউর রহমান ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈত্রিক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেনী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৬১ সালে যোগ দেন বিমান বাহিনীতে। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর রহমান সপরিবারে ঢাকায় দুই মাসের ছুটিতে এসেছিলেন। ২৫ মার্চের কালরাতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হওয়া সত্তে¡ও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সঙ্গে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন। একটা সময় তিনি উপলব্ধি করলেন, যুদ্ধে জিততে হলে একটা যুদ্ধবিমান চাই তার। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান। মতিউর রহমানের চিন্তা তখন কেবল একটি বিমানের। সহকর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন আর সুযোগ খুঁজছেন তিনি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে একাত্তরের ২০ আগস্ট করাচির মাশরুর বিমানঘাঁটি থেকে একটি টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিনতাই করেন। বিমানটির নবীন পাইলট ছিলেন পাঞ্ছাবি রাশেদ মিনহাজ। বিমান স্টার্ট হতেই মতিউর রহমান ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলেন, বিমানের পাখায় সমস্যা। তারই ছাত্র রশিদ মিনহাজ শিক্ষকের কথা অনুযায়ী বিমানের ‘ক্যানোপি’ খুলতেই তাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে বিমানের পেছনের সিটে লাফিয়ে উঠে বসলেন মতিউর রহমান। কিšদ জ্ঞান হারাবার আগে মিনহাজ বলে ফেললেন, ‘আই হ্যাভ বিন হাইজ্যাকড’। বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মতিউর রহমান ছুটে চললেন। কিšদ ততক্ষণে এফ-৮৬ যুদ্ধবিমান ও একটি হেলিকপ্টার তাকে ধাওয়া করা শুরু করে কন্ট্রোল টাওয়ারের নির্দেশে। বিমানটি যখন ভারতীয় সীমান্তের দিকে যাচ্ছে তখন রশিদ মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসে এবং তিনি মতিউর রহমানের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করেন। এক পর্যায়ে সিন্ধু প্রদেশের জিন্দা গ্রামে আছড়ে পড়ে বিমানটি। শহিদ হন আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান।