Channel 786 | চ্যানেল ৭৮৬ | Community Bangla Newspaper

‘র‌্যাংকিং নয়, ঢাবিকে বিচার করুন জাতিসত্ত্বার জন্মদাতা হিসেবে’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২:৪৪, ৮ ডিসেম্বর ২০২২

আপডেট: ১৯:২৭, ৯ ডিসেম্বর ২০২২

‘র‌্যাংকিং নয়, ঢাবিকে বিচার করুন জাতিসত্ত্বার জন্মদাতা হিসেবে’

প্রায় দুই বছরের প্রস্তুতি শেষে নিউইয়র্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন করা হয়েছে। ২৬ নভেম্বর লাগোর্ডিয়া প্লাজা হোটেলে এই উদযাপন সম্পন্ন হয়। ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশন অব ইউএসএ-এর উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত শত শত এলামনাই অংশ নেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। তার ইষৎ সংক্ষেপিত বক্তব্য তুলে ধরা হলো—

আমি ভীষণ আনন্দিত। আপনারা ইতিহাস তৈরি করেছেন। নিউইয়র্কে আপনারা পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিচ্ছবি, একটি রেপ্লিকা দাঁড় করিয়েছেন। এ পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনের যতগুলো আয়োজনে অংশ নিয়েছি, তার মধ্যে আপনাদেরটা একেবারেই ব্যতিক্রম। এটা আপনাদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। সব মানদণ্ডেই আপনাদের এই আয়োজন উত্তীর্ণ। আপনাদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।

একজনকে আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তিনি হলেন আমাদের সাঈদা আক্তার লিলি আপা। তিনি আমার কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়, বড় বোনের মতো। এই মানুষটি যখন একদিন আমার সঙ্গে দেখা করে এই অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জানালেন, আমি না করতে পারিনি। এটা ভেবে আমার আনন্দ লাগে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন অমায়িক, বিনম্র মানুষ তৈরি করেছে। 

এই অনুষ্ঠানের স্টেজে যে দুটি প্রতীক আপনার দেখিয়েছেন, তার একটি হলো শহীদ মিনার আরেকটি অপারাজেয় বাংলা। এই দুটি বাংলাদেশের খুব প্রনিধানযোগ্য স্থাপনা। এই স্থাপনাগুলো কোন ইতিহাসের প্রতিনিধিত্ব করে এবং সেই ইতিহাস কে কিংবা কারা তৈরি করেছেন, সেদিকে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই চেতনার বিকাশ ঘটেছিল মহান ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। সেই ভাষা আন্দোলনের যিনি পুরোধা ব্যক্তি, যিনি এর নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রথম রাজবন্দী হিসেবে কারাগারে গিয়ে যিনি ভাষা আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন, তিনি আর কেউ নন—সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর আরেকধাপ এগিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।

বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্ব পরিমণ্ডলে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই উন্নয়ন যে মানুষের নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে তিনি হলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ আজ যে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, সেটার জন্য আমরা নাগরিক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। গর্বের বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু এবং তার কন্যা শেখ হাসিনা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী। রাষ্ট্রের জন্মদাতা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আবার উন্নয়নের রোলমডেল বাংলাদেশের স্রষ্টা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী—সে বিশ্ববিদ্যালয় গর্ব করতেই পারে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

র্যাং কিং কিংবা গ্রেডিং নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। আপনারা পৃথিবীর একটি উন্নত অংশে বসবাস করেন। আপনাদের জানার কথা, কীভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাং কিং হয়ে থাকে। কোন কোন সূচকের মাধ্যমে একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গ্রেডিং করা হয়, সেটা আপনারা জানেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার জাতির আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারল, সেটা কিন্তু সূচকে উঠে আসে না। তাই র্যাং কিংয়ের বিষয়টা সামনে এসে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মেলানো যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমি মনে করি না। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমরা বিষয়টা জানিয়েছি। 

সম্প্রতি এসোসিয়েশন অব কমনওয়েথ ইউনিভার্সিটিজ একটি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একজন কাউন্সিল মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। সেই সভায়ও র্যাং কিংয়ের বিষয়টা বারবার উঠে এসেছে। যে বিশ্ববিদ্যালয় জাতিসত্ত্বার জন্মের সঙ্গে যুক্ত সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে কখনো বর্তমান র্যাংকিংয়ের মানদণ্ডে বিবেচনা করা উচিত নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছিল একটি টিচিং ইউনিভার্সিটি হিসেবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অক্সফোর্ড অব দ্যা ইস্ট বলা হয়। কেন বলা হয়—তার যৌক্তিক কারণ আছে। অক্সফোর্ড মডেলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবয়ব দেওয়া হয়েছিল। সেটা হলো এখানে টিউটোরিয়াল সিস্টেম থাকবে এবং আবাসন সুবিধা থাকবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু সেখানেই আছে।

তবে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাং কিং করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, উদ্ভাবন এবং এর এলামনাই নেটওয়ার্ক, রেপুটেশন, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া এলায়েন্স এর মাধ্যমে। আপনারা জানেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো সাউথ এশিয়াতেই বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোতে এই বিষয়গুলোর অভাব রয়েছে। বিশেষকরে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া এলায়েন্স বিষয়গুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এখনো ওভাবে দাঁড়ায়নি। এই দুই বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করার কিছু কিছু উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাং কিংয়ের ক্ষেত্রে যেসব প্যারামিটার বিবেচনায় নেওয়া হয়, সেসব ক্ষেত্রে আমরা যোজন যোজন পিছিয়ে। এখন আমাদের প্রধান কাজ হবে এই প্যারামিটারগুলোর আদলে বিশ্ববিদ্যালয়তে পুনর্নিমান, পুর্নগঠন করা। বিশ্বের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা আলাদা উইং থাকে যাদের কাজ হচ্ছে প্যারামিটারগুলো এড্রেস করে র্যাং কিংটা ওপরের দিকে নিয়ে আসা। আমাদের এখানে আমরা সেটা করতে পারিনি।

আজকে আপনারা যারা এখানে আছেন, অনেকেই খুব বিদগ্ধ। আপনারা অনেকেই বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানজনক অবস্থানে আছেন। এই আপনারাই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, তারপর এখানে চলে এসেছেন। এটা একটা ব্রেইন ডেইন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভালো সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন বলেই আপনারা এখানে থাকছেন। আপনাদের মতো মানুষগুলোকে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধরে রাখতে পারতো, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা আরও সমৃদ্ধ হতাম। 

আপনাদেরকে ধরে রাখতে পারলে মর্যাদার প্রশ্নে, উৎকর্ষের প্রশ্নে, গবেষণার প্রশ্নে আমরা আরও এগিয়ে যেতে পারতাম। র্যাং কিং নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে এই বিষয়টাও কিন্তু ভেবে দেখতে হবে। তবে এই পয়েন্টে আমরা এখন নতুন কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। কীভাবে ভালো শিক্ষার্থীদের ধরে রাখা যায়, সেদিকে মনোযোগ দিয়েছি আমরা।

আপনাদের হয়তো দুটি খবর জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক র্যাং কিংয়ে সম্প্রতি আমাদের বেশ উন্নতি হয়েছে। টাইমস হায়ার এডুকেশন এবং কিউএস র্যাং কিং—এই দুটোর মূল্যায়নে এশিয়াতে এবং বিশ্বের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনেক ওপরে উঠে গেছে। তালিকার কত নম্বরে আছে সেটা আমি বললাম না। আশাকরি আপনারা দেখে নেবেন। অন্তত ৪০০-৫০০ পয়েন্ট এগিয়ে গেছি। 

তবে এটা উচ্ছ্বাসের কোনো বিষয় নয়। র্যাং কিংকে টার্গেট করে আমরা কতগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, তবে সেগুলো সাসটেইন করবে কিনা, সেটা নিয়ে আমার কিছুটা সন্দেহ আছে। কারণ এর সঙ্গে আরও অনেক বিষয় জড়িত। একটা খারাপ হলে তার প্রভাব পড়ে সবগুলোর ওপর। 

আরেকটি বিষয় হলো, একটি বিশ্ববিদ্যালয় তখনই র্যাং কিংয়ে ভালো করে কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে ভালো অবস্থানে থাকে, যখন ক্যাম্পাসটি ইন্টারন্যাশনাল হয়। ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পাসের কিছু বৈশিষ্ট আছে। যারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে, তারা বিষয়টা ভালো জানবেন। বৈশিষ্টগুলো হলো- ক্যাম্পাসে ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজের চর্চা হবে খুব বেশি। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির উপস্থিতি খুব শক্তিশালী হবে। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস, ফ্যাকাল্টি মেম্বারস থাকবে খুব বেশি। এখন আমাদের ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টো ঘটনা। ব্রেনডেইনের ফলে আমাদের ভালো স্টুডেন্টরা আর আমাদের ক্যাম্পাসে থাকছেন না, তারা চলে যাচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে। এটি একটি বড় সংকট, যা আমরা গভীরভাবে অনুভব করছি।

এই সংকট কাটাতে আমরা আইনের মধ্যে কিছু পরিবর্তন এনেছি। যাতে বাইরের দেশের নামকরা ফ্যাকাল্টিকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত করতে পারি এবং আপনাদের মতো যারা বিদগ্ধ একাডেমিশিয়ানরা আছেন, তাদেরকে যুক্ত করতে পারি। আমি মনেকরি, এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটবে। 

আরেকটি বিষয় আমি বলতে চাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস কিংবা কারিকুলাম কিন্তু একদম আপডেটেড। কারণ এখন আউটকাম বেজড এডুকেশনের সময়। সেই বিষয়টার প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা আমাদের সিলেবাস হালনাগাদ করে থাকি। ইনস্টিটিউশন অব কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স সিলেবাস হালনাগাদ করার যে প্যারামিটারগুলো দিয়ে থাকে, সেগুলো অনুসরণ করেই আমরা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে আপনাদের পরামর্শও চাই। 

কারিকুলাম হলো এমন একটি বিষয় যার বিকাশ ঘটাতে হয়। এটাকে বলে কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট। কারিকুলাম কখনো একদিনে তৈরি হয় না। এটা একটা বিবর্তনীয় পদ্ধতিতে এগুতে থাকে। আমরা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডাডে সেটা করে যাচ্ছি। বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা কারিকুলাম এক্সপার্ট আছে আমরা তাদের পরামর্শ অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এই একটা বিষয়ে এগিয়ে গেলে তো হবে না, আরও অনেকগুলো বিষয়ে আমরা স্থবির হয়ে আছি। সেগুলোতে মনোযোগ দিতে হবে।

অর্থের সংকট আমাদের আছে, তবে আমি সেটাকে বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করি না। কিছুদিন আগে আমি লন্ডন সফরে ছিলাম। সেখানে আমাদের অন্তত ৫০ জন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তারা একটি বিষয়ে বর্তমান সরকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করেছেন। আর সেটা হলো- বঙ্গবন্ধু স্কলারশিপ। এই স্কলারশিপের মাধ্যমে আমরা অনেক মেধাবীকে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠাতে পারছি। 

১৯৭৩ সালেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটি প্রবর্তন করেন। তারপর তার শাহাদাত বরণের মধ্য দিয়ে এটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার এটি চালু করে। পরবর্তী সরকার আবার সেটি বন্ধ করে দেয়। আমাদের সৌভাগ্য হলো, আমি উপাচার্য হওয়ার পর সরকারের বিশেষ অনুদানে ২০১৭ সালে আবার চালু হয় বঙ্গবন্ধু স্কলারশিপ। এই স্কলারশিপে অর্থের যে পরিমাণ সেটা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যার্ন্ডাডের। এই মুহূর্তে অন্তত ৬০-৭০ জন এই স্কলারশিপ উপভোগ করছে। তাদের পেছনে আমাদেরকে ব্যয় করতে হচ্ছে হাজার হাজার ইউএস ডলার ও পাউন্ড। বিশ্বে সম্ভবত খুব কম বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা তাদের তরুণ শিক্ষকদের এমন উচ্চমানের স্কলারশিপ দিয়ে বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছে। 

তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো, যাদেরকে আমরা স্কলারশিপ দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছি, তাদের কেউ কেউ আর দেশে ফিরছেন না। এখন থেকে আমরা বিষয়টা আর মেনে নেব না। এ ব্যাপারে আমরা একটা কঠিন আইন করেছি। কেউ যদি এই স্কলারশিপ ভোগ করার পর আর দেশে না ফেরে, তাহলে তাকে স্কলারশিপের পুরো অর্থটাই ফেরত দিতে হবে। 

দিনকয়েক আগে লন্ডনে আমার সঙ্গে স্কলারশিপ পাওয়া ২৫ জন দেখা করল। আমি তাদেরকে আইনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছি, পিএইচডি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান শুরু করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, আরও কয়েক বছর আমরা এই আইনটি যথাযথভাবে কার্যকর করতে পারলে আপনাদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হতে পারবো।

এখানে আপনাদেরকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। বিদেশের মাটিতে আপনাদের এত সুন্দর আয়োজন আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনাদের ভদ্রতা-নম্রতা, মূল্যবোধ অসাধারণ। এই ক্রেডিটটাও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হবে। আমি মনে করি, ঢাবি ক্যাম্পাস আপনাদেরকে তৈরি করেছে বলেই আপনাদের দ্বারা এত সুন্দর একটি কাজ সম্পাদিত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আপনাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক মূল্যবোধ চর্চা করা শিখিয়েছে। সেই মূল্যবোধ নিয়ে আপনারা যখন দেশ-বিদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছেন, তখন আপনার মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের এম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানো মানেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ নয়। সেটা বরং এক ধরনের শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় এতদিন আপনাদেরকে দিয়েছে, এবার আপনারা বিশ্ববিদ্যলয়কে দেবেন।

আজকের বাংলাদেশের যে অর্জন, তার পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। তবে এর পশ্চাতে যে মানুষটির সবচেয়ে বড় অবদান তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দ্বিতীয় অবদান যার, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিছুদিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সেখানে স্পিকার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন একজন নোবেল বিজয়ী। তিনি তার বক্তব্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে দারুণ ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি মনে করি, বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় অনায়াসেই থাকবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী এবং সিভিল সোসাইটির উপস্থিতিতে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন।

এই অসাধারণ আয়োজন যারা করেছেন আমি তাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাই। এটাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গৌরব। পৃথিবীর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই কি ভিনদেশে কখনো এত সুন্দর আয়োজন করতে পেরেছে। আমার মতে, করতে পারেরি। আপনারা যারা বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করছেন তারা এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। এগুলোকে ইন্সপাইরেশন হিসেবে গ্রহণ করতে পারি আমরা। 

তবে একটি ব্যাপারে আমাদেরকে সাবধান থাকতে হবে, সেটা হলো- কোনোভাবে যেন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ভুল বার্তা ছড়িয়ে না পড়ে। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কমিউনিটি এনগেজমেন্টের ধারণাটি খুব একটা প্রচলিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শক্তিশালী কমিউনিটি এনগেজমেন্ট থাকলে ভুল ধারণা কম জন্ম নেয়। তাই আমরা এ বিষয়ে জোর দিচ্ছি।

আপনাদের এই সম্মেলনে যোগ দিতে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি প্রায় ১৮ বছর পর। আপনাদের এই উদ্যোগের ফলেই আমার এখানে আসা হয়েছে। আমি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে বোস্টন কলেজে এসেছিলাম ২০০১ সালে। এর পরের ৪ বছরে অনেকবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি এবং বিভিন্ন স্থানে থেকেছি। দীর্ঘদিন পর আবার আপনাদের আমন্ত্রণে এখানে আসা হলো। আমাকে এই সুযোগ প্রদান করায় আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়কে এগিয়ে নিতে আমরা যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, আমি চাই আপনারা সেইসব উদ্যোগে আমাদের সঙ্গে সামিল হবেন। আপনাদের মতো বিদগ্ধজনের প্রতি এটা আমার অনুরোধ। প্রতিটি বিভাগকে আমরা বলে দিয়েছি, সাবেকদের মধ্যে যারা রিসোর্স পারসন আছেন, তাদেরকে যেন বিভাগের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। শুধু বিভাগে পড়ানো মানেই যুক্ত হওয়া নয়, আরও নানা উপায়ে যুক্ত করা সম্ভব।

আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আপনাকে খুঁজে খুঁজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য আহ্বান জানানো। একইসঙ্গে আপনার দায়িত্ব হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে আপনি যে উচ্চতায় দেখতে চান সেটার জন্য নিজেকে যুক্ত করা। চাইলে আপনাদের পক্ষ থেকেও পরামর্শ দিতে পারেন যে, কীভাবে আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। সেই উপায় আপনাকেও খুঁজে বের করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাইয়ের কনট্রিবিউশনে চলে। কিন্তু আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারিনি। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ দেবে আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেটা নিয়ে বিদেশের মাটিতে যাবে, এটাই শেষ কথা হতে পারে না। এলামনাইরাও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে। আপনাদের নামেও কিছু সুনির্দিষ্ট রিচার্স হতে পারে। বিনিময়ে সেখানে আপনারা অর্থ সহায়তা করলেন। বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্প করা যেতে পারে। এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় বড় ভবন হয় এলামনাইয়ের নামে। সেই রকম উদাহরণ আমরা কেন সৃষ্টি করতে পারি না। আমার আহ্বান থাকবে, আপনারা এগিয়ে আসুন। আপনারা যদি এমন কোনো উদ্যোগ নেন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানাবে। 

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাং কিংয়ে এবং সার্বিক উন্নয়নে গবেষণা প্রকল্পের কোনো বিকল্প নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কতটা পরিচিতি পাবে, সেটাও নির্ভ করে তার গবেষণা কর্মের ওপর। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমরা এদিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছি। তাই আপনাদের প্রতি সদয় আবেদন জানাই, আপনারা এগিয়ে আসুন। এই কথাগুলো আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় এলামনাই এসোসিয়েশনকেও বলেছি।

অনেকক্ষণ ধরে আপনারা আমার কথা শুনেছেন, আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই। আপনাদের সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের শুভেচ্ছা। আপনারা সকলে ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিরজীবী হোক, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।


চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ইমেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected]। আপনার পণ্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।

সংবাদটি শেয়ার করুনঃ