বর্ষা...মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের অঞ্চলগুলোতে উদযাপিত একটি ঋতু, যখন মৌসুমী বায়ুর প্রভাব সক্রীয় হওয়ায় প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুয়ায়ী এটি হচ্ছে বাংলা বছরের দ্বিতীয় ঋতু, যেখানে আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস জুড়ে এই বর্ষাকাল ব্যাপৃত থাকে। বাংলা বছরে, বর্ষার আগের ঋতুটি হলো রৌদ্রতপ্ত গ্রীষ্ম আর পরের ঋতুটি হলো শ্যামল শরৎ।
বর্ষায় চারপাশ মুখরিত থাকে কদম, কেয়া, কামিনী, বেলি ও বকুলের সুবাসে। বর্ষায় ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- কদম, বকুল, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, গুলনার্গিস, দোপাটি ও অলকানন্দ প্রভৃতি।
বর্ষাকালের সাজসজ্জাঃ গরমে সুতি কাপড়ের জুড়ি নেই। কিন্তু সমস্যা হলো ভিজে গেলে শুকাতে একটু সময় নেয়। আর ভেজা অবস্থায় গায়ের সঙ্গে লেগে থেকে অস্বস্তিও সৃষ্টি করে। এমন ঋতুতে তাই পাতলা জর্জেট বা শিফন কাপড়ের পোশাক পরা ভালো। এতে খুব বেশি গরমও লাগবে না আবার বৃষ্টিতে ভিজলে শুকাতে সুতি কাপড়ের চেয়ে কম সময় নেবে। তবে শিফন নিয়মিত ব্যবহারের উপযোগী নয়। লিনেন কাপড় এ সময়ের জন্য সেরা। গরমের জন্য আরামদায়ক তো বটেই, আর ভেজার পর বাতাসের নিচে থাকলে অল্প সময়েই শুকিয়ে যায়।
টানা বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে গেলে অনেক সময় পায়জামা বা প্যান্ট গুটিয়ে রাস্তায় নামতে হয়। এ জন্য এমন সময় পালাজ্জো বা স্কার্ট এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। শর্ট কুর্তা বা সেমি লং কামিজের সঙ্গে এখন পরতে পারেন জিনস, পেনসিল প্যান্ট, লেগিংস বা লিনেনের ট্রাউজার। আঁটসাঁট ও সাদা-কালো রঙের পোশাক এই সময়ের জন্য নয়।
ছেলেরা সুতির হাফহাতা শার্ট পরতে পারেন। আবার কৃত্রিম তন্তু ও সুতির মিশ্রণে তৈরি পোশাকও এ সময় পরা যেতে পারে। ছেলেরা পোশাক কেনার আগে লেবেল দেখে নিতে পারেন। বেশির ভাগ সময়েই ছেলেদের শার্ট ও টি-শার্টে কাপড়ের উপাদান ও এর পরিমাণ দেওয়া থাকে। সুতি আর সিনথেটিক সমান পরিমাণে আছে, এমন পোশাক এই ঋতুতে সবচেয়ে ভালো, যদি কারও সিনথেটিক কাপড়ে অস্বস্তি না লাগে। বৃষ্টি হলেই কাদা হবে, এ কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়ই প্রয়োজন নেই। ছোট করে মনে করিয়ে দিই, বৃষ্টির মধ্যে চামড়ার জুতা একদম পরা যাবে না। আজকাল বাজারে প্লাস্টিকের কিছু জুতা পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো পরা যেতে পারে। বর্ষায় কাদা থেকে পা বাঁচাতে অনেকে উঁচু স্যান্ডেল পরেন। তবে অভ্যস্ত না হলে উঁচু জুতা পরা উচিত নয়। এতে বরং দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর জুতা কেনার সময় সোল দেখে নিতে হবে। পিচ্ছিল সোলের জুতা-স্যান্ডেল শুধু এই মৌসুমে নয়, সব সময় এড়িয়ে চলা উচিত। বৃষ্টির দিনে পাট ও চামড়ার ব্যাগও আলমারিতে তুলে রাখুন। ভিজে গেলেই শেষ! বর্ষায় বাইরে যাওয়ার আগে সঙ্গে যা যা রাখতে পারেন
১। ছাতা বা রেইনকোট। ভেজা ছাতা ও রেইনকোট অনেক সময় বাইরে মেলে দেওয়া সম্ভব হয় না। ভেজা ছাতা নিয়ে কোনো অফিস বা মার্কেটে গেলে তা থেকে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে, যা খুব বিব্রতকর। এ জন্য ব্যাগে বড় একটি পলিথিনের ব্যাগ রাখতে পারেন। ভেজা ছাতা ও রেইনকোট সঙ্গে সঙ্গে মেলে দিতে না পারলে সেই প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখুন।
২। ব্যাগে রুমাল রাখা যেতে পারে। ভিজে গেলে গা ও চুল মুছে নিতে পারবেন।
৩। ছোট একটা পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ পকেটে রাখুন। মোবাইলকে ভিজে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন।
৪। অফিসে পরার জন্য একটি বাড়তি স্যান্ডেল ও সম্ভব হলে বাড়তি পোশাক রাখুন। কাকভেজা হয়ে গেলে পরনের পোশাক পালটে নিতে পারেন।
৫। মেয়েরা এ সময় লিপস্টিক, আইলাইনার, মাসকারা ইত্যাদি প্রসাধনী ব্যবহারের আগে তা পানিরোধক কি না, দেখে নেবেন।
বর্ষার খাদ্য তালিকাঃ বর্ষা মানেই প্রেম। বর্ষা মানেই খিচুড়ি-ইলিশ। বৃষ্টি ভেজা বিকেলে মুচমুচে পাকোড়া, চপ-সিঙাড়া। তেলেভাজা-মুড়ি। ভালবাসি ভেলপুরি, পাপড়িচাট। কিন্তু নিজের শরীরটাকেও তো ভালবাসতে হবে। রসনার তৃপ্তি মেটাতে গিয়ে যেন শরীরে বাসা না বাঁধে হাজারো অস্বস্তি। বদহজম, পেটখারাপ, জ্বর।
বর্ষার হাত ধরেই আসে এই সব উপসর্গ। বাঁচার উপায় কী? খাবার বেছে খান। কিছু ভাল লাগার খাবার বর্ষাকালে এড়িয়ে চলুন। কারণ, বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে বেশি ভাজা যে কোনও খাবার এই সময় হজম করতে সমস্যা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষাকালে অতি সুস্বাদু কিছু খাবার এড়িয়ে চলতেই হবে। বর্ষাকালে আর্দ্রতা বেশি থাকে। হজমের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। জলবাহিত ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ও ভাইরাল সংক্রমণ এই সময় বেশি। বর্ষাকালে শাক খুব দ্রুত পচে যায়। ব্রকোলি, বাঁধাকপি, ফুলকপিতে বাসা বাঁধতে ভালবাসে পোকামাকড়। সমুদ্রের মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া বর্ষাকালে এড়িয়ে চলার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। কারণ, এই সময় ওদের বংশবৃদ্ধির সময়। তাই, টাটকা পাওয়া মুশকিল। খাদ্যে বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা। রাস্তার কেটে রাখা ফলে সবসময়ই বিপদ। বর্ষাকালে সমস্যা আরও বেশি। আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে এই সব কাটা ফলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ দ্রুত হয়। রেড মিট গুরুপাক। বর্ষাকালে যেহেতু হজমের সমস্যা বাড়ে, তাই গুরুপাক খাবার এড়িয়ে চলাই ভাল। তবে চলতে পারে চিকেন স্যুপ। ঠাণ্ডা পানীয় শরীর থেকে মিনারেল কমিয়ে দেয়। ফলে হজমের ক্ষমতাও কমে যায়। জল ও লেবু-জল বেশি করে খাওয়া যেতে পারে। আদা চা বিকল্প হতে পারে। বর্ষাকালে পরিবেশ একটু ঠাণ্ডাই থাকে। জল খাওয়ার প্রবণতাও কমে যায়। গলদ সেখানেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সময় সারাদিনে অন্তত ৮ গ্লাস জল খেতে হবে।
বর্ষাকালের উপকারিতাঃ বর্ষাকালে কৃষকেরা আউশ ধান ঘরে তোলে। বাংলাদেশের প্রধান অর্থকারী ফসল পাট বর্ষষাকালেই কৃষকের ঘরে আসে। এ সময়ে ফজলী আম, আনারস, পেয়ারা, চালকুমড়া, ঝিঙ্গা, উচ্ছে, পুইশাক, চিচিঙ্গা ইত্যাদি ফসল ও সবজির সম্ভার দেখা যায়। বর্ষার ভরানদী উর্বর পলিমাটি বহন করে ভূমিকে উর্বর করে বর্ষাকালের
অপকারিতাঃ বর্ষাকালের কিছু কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। অতিবৃষ্টির ফলে ফসল নষ্ট হয়, ডুবে যায় রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ি। অনেক সময় অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা দেখা দেয়। ... এ সময় জিনিসপত্রের দাম অধিক হারে বেড়ে গরীব মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। বর্ষার অপকারের চেয়ে উপকারই বেশি।
বর্ষা না হলে আমাদের দেশ মরুভূমিতে পরিণত হত। শুধু বর্ষার কারনেই এ দেশ সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা নামের অধিকারী হতে পেরেছে। আর তাই আমরা বর্ষাকে জানাই সাদর সম্ভাষন। শহর কিংবা গ্রামে, বনজঙ্গল বা নদীর পাড় বর্ষার চোখজুড়ানো রূপ মুগ্ধ করে। ভালো লাগে বর্ষার সদ্য স্নাত স্নিগ্ধ প্রকৃতি। ভালো লাগে আকাশ, অবারিত মাঠ, টলমলে জলের পুকুর, ভেজা সবুজ পাতা, ঘাস। গ্রামে গেলে এখন সোঁদা গন্ধ আমেজ মিলবে, মিলবে বৃষ্টি ধারাপাত। বৃষ্টিধোয়া প্রকৃতির রূপে বিমোহিত হয় মানবসন্তানেরা। এই সময় প্রকৃতিকে বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। মনের গতিপ্রকৃতিও কেমন কাব্যময় হয়ে ওঠে। একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেলে, ভূমি ভিজে উঠলে, মাটির সোঁদা গন্ধে আমরাও কেমন ভিজে উঠি। এই সময়টায় গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে থাকলে যত দূর চোখ যায়, নিবিড় সহজ সবুজ দেখা যায়। এখন শহর থেকে গ্রামে কেউ কাউকে ফোন করলে প্রথমেই জানতে চান, তোমার ওখানে বৃষ্টি কেমন হচ্ছে। বৃষ্টি যে হচ্ছে সেখানেও, সেটা শুনেও মন ভালো হয় কারও কারও। ভিজতে ইচ্ছে করে। ইট-পাথরের নগরী ছাড়তে ইচ্ছে করে।