যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ল্যাংকেস্টার কাউন্টিতে আমিশ জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। সেদিন আমিশ পল্লিতে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত গান, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’। কিন্তু এই পাহাড়ে ঝরনা ছিল না, ছিল অসংখ্য বৃক্ষের সারি আর হলুদ সবুজে মেশানো উপত্যকা। সেদিন ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও আবহাওয়া ছিল আমাদের অনুকূলে।
আমরা যখন পল্লির সীমানায় পৌঁছালাম তখন স্থায়ীয় সময় বিকেল সাড়ে চারটা। হঠাৎ নাতি-নাতনিরা চিৎকার করে উঠল, হর্স রাইড বলে। তাকিয়ে দেখি পল্লির জমকালো পিচ রাস্তায় টগবগিয়ে চলছে একটা ঘোড়ার গাড়ি। এক আমিশ দম্পতি তাঁদের দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন হয়তো। এর আগে আমিশদের নিয়ে অনেক কাহিনি পড়েছি, কিন্তু আজ সরাসরি দেখে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জনের কথা ভেবে অনেকটা আপ্লুত হলাম।
নির্দিষ্ট ফি নিয়ে আমাদের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। মধ্যবয়সী এক নারী স্কুলের ক্লাস রুমের মতো ৮-১০টা লম্বা বেঞ্চ রাখা ঘরে ইশারায় সবাইকে বসিয়ে আমিশ জাতি নিয়ে ধারাবাহিক বর্ণনা দিতে লাগলেন। একপর্যায়ে আমাদের হতাশ করে দিয়ে বললেন, আজ আমিশরা এখানে নেই। রোববারের প্রার্থনায় ওরা চার্চে গেছে। তবে ওরা থাকা না-থাকা কোনো ব্যাপার না। কারণ ওরা কারও সঙ্গে কথা বলে না, ছবি তুলতে তারা পছন্দ করে না। ক্যামেরা মোটেই তাদের পছন্দ নয়। পর্যটকেরাও সৌজন্যের খাতিরে তাদের ছবি তোলে না।
নিজেদের চার্চ, স্কুল ঘর বা বাস করার ঘর এই জাতির মানুষেরা নিজেরাই তৈরি করে। তাদের কমিউনিটির সব সদস্য একটা ইউনিট হিসেবে কাজ করে। তাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কিছু আসবাবপত্র, তৈজসপত্র আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখানো হলো। দেখে মনে হলো, ৫০ বছর আগের বাংলাদেশের গ্রামের কথা। যেখানে বিদ্যুৎ ছিল না, লোকজন হ্যারিকেন বা কুপি জ্বালিয়ে রাতের কাজ করত। গরমে আমিশদের ফ্যান নেই, তারা হাতপাখা ব্যবহার করে। শীতের দিনে কাঠ বা কয়লা জ্বালিয়ে ঘর গরম রাখে। আমাদের দেশের নারীদের মতো হাত দিয়ে কাপড় ধোয়ার কাজ করে। বাড়ির আঙিনায় এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত দড়ি টাঙিয়ে রোদে কাপড় শুকাতে দেয়। এমনকি আধুনিক যন্ত্রচালিত কোনো যানবাহন তারা ব্যবহার করে না। প্রত্যেক পরিবারে একটি করে ঘোড়ার গাড়ি আছে।
পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নির্ভুলভাবে নিজেদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রক্ষায় বিশ্বাসী সুইজারল্যান্ডের ‘জ্যাকব আম্মান’এর নাম থেকে ‘আমিশ’ নামকরণ। আমিশ অর্থ সত্যবাদী। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের হোমস কাউন্টিতে আমিশদের সবচেয়ে বড় কমিউনিটির বাস। সাধারণত পেনসিলভানিয়া, ওহাইও, ইলিনয়, আইওয়া, নিউইয়র্ক, মিসৌরি স্টেটে তাদের দেখা যায়। এরা বিশেষ এক সম্প্রদায়, যারা বর্তমান প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, বিজ্ঞান মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলেছে। তাই তারা সব ধর্ম থেকেই নিজেদের আলাদা করেছে। খুবই শান্তিপ্রিয় এই সম্প্রদায়।যেন প্রকৃতির আইন দিয়ে ঘেরা তাদের আরেক জগৎ।
এই প্রযুক্তির যুগে জীবন যেখানে প্রযুক্তির কাছে জিম্মি তখন আমিশদের প্রযুক্তিবিহীন সাধারণ জীবন শহুরে মানুষদের নিত্য ভাবায়, অবাক করে দেয়। তারা নিজেদের তৈরি প্লেইন ফেব্রিকসের পোশাক পরে। পুরুষের পোশাক সাধারণত সাদা ফুলহাতা শার্টের ওপর কালো লম্বা জোব্বা এবং কাউবয়দের মতো টুপি পরে। মেয়েরা সাধারণত সাদা পোশাকের ওপর নীল রঙের কুর্তা পরে।
মেয়েরা চুল কাটে না। ছেলেদের গোঁফ রাখা নিষেধ কিন্তু বিয়ের পর ছেলেরা সাধারণত দাঁড়ি বড় করে। ছেলেদের টাই, বেল্ট পরাও নিষেধ। তাদের প্রধান পেশা কৃষি। এ ছাড়া কেউ কেউ কার্পেন্টার, কামার, কুমার। এরা নিজেদের ফসলাদি নিজেরাই ফলায়। ঘোড়া তাদের পারিবারিক ট্রেডমার্ক। ফসল ফলানো থেকে শুরু করে যাতায়াতের কাজে ঘোড়া ব্যবহার করা হয়।
পেনসিলভানিয়ার ল্যাংকাস্টার কাউন্টিতে এলেই প্রকৃতি তার আপন শোভায় যেন প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানাবে। এই ছোট শহরের কালো পিচের রাস্তার দুই পাশে দেখা যাবে ঝকঝকে সুন্দর ছবির মতো এক একটা ছোট্ট গ্রাম। যত দূর চোখ যায়, দেখা যাবে সারি সারি ফসলের মাঠ। আমিশরা কেউ ঘোড়া দিয়ে হালচাষ করছে, কেউ ঘোড়ার গাড়িতে ফসল তুলতে ব্যস্ত।
এই জাতির অর্থ আর ক্ষমতায় কোনো লোভ নেই। তারা সরকারি কোনো সাহায্য নেওয়াকে তাদের চেতনা বিরোধী বলে মনে করে। আমিশদের কোনো মেডিকেল ইনস্যুরেন্স নেই। প্রতিটি পরিবার বছরে দুইবার গির্জায় অনুদান দেয়। কমিউনিটির কেউ অসুস্থ হলে সেই অর্থ থেকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
কৃষিকাজ করে জীবনযাপনে এরা বেশি আগ্রহী। পুরুষ আমিশরা মাঠে ভুট্টা, তামাক, সয়াবিন, বার্লি আলুসহ বিভিন্ন শাকসবজির চাষ করে থাকে। আমিশ মেয়েরা কাপড় বোনে, মধু তৈরি করে, ফুল আর ফলের চাষ করে। আমিশরা নিরক্ষর নয়। তারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে। ভূগোল, গণিতের সঙ্গে ইংরেজি ও ডাচ ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। অষ্টম গ্রেড শিক্ষার পর ভকেশনাল স্কুল শুরু হয়। যাকে বলা হয় হাতে কলমে শিক্ষা।
আমিশরা ১৬ বছর বয়স হওয়ার পর থেকেই নিজেদের জন্য পাত্র-পাত্রী খোঁজা শুরু করে। বিয়েতে দীর্ঘমেয়াদি অনুষ্ঠান হয়। আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করে বিশাল ভোজের ব্যবস্থা করা হয়। বিয়ের কনে কোনো বিশেষ পোশাক বা গয়না পরে না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আমিশরা পরিবার পরিকল্পনায় বিশ্বাসী নয়। প্রতিটা পরিবারে গড়ে কমপক্ষে সাতজন ছেলেমেয়ে থাকে।
১৭১০ সালের দিকে আমিশরা যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যে আসে। তারা উইলিয়াম পেন নামের এক জমিদারের কাছ থেকে ১০ হাজার একর জমি কিনে ল্যাংকাস্টার কাউন্টিতে প্রথম বসবাস শুরু করে। ১৭২৭ সালের ২ অক্টোবর অ্যাডভেঞ্চার নামক জাহাজে মাত্র ১৩ জন আমিশ প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রে আসে। এর বছর দশেক পরে; চার্মিং ন্যান্সি নামক জাহাজে করে অসংখ্য আমিশ পেনসিলভানিয়ায় আসতে শুরু করে। ১৯২০ সালের জনমত জরিপে আমিশদের সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের মতো। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন লাখে।
আমিশরা সহজ সরল জীবনের মাঝে বেঁচে থেকে যে সুন্দরকে অবলীলায় ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আমিশদের সহজ সরল জীবন আমাদের প্রকৃতি প্রেমে নিত্য উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের বলতে ইচ্ছে করে প্রকৃতির জয় হোক, আর জয় হোক মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার।