জাহিদ হোসেন
আলহাজ জোবেদা বেগম। প্রচারের আড়ালে থাকা একজন মহিয়সী নারী, আদর্শ মা, একজন রত্নগর্ভা। ভাষাসৈনিক আলহাজ মো. ওসমান আলীর সহধর্মিণী। সন্তানরা সবাই দেশ-বিদেশে সুপরিচিত এবং সুশিক্ষিত। গতকাল (৫ সেপ্টেম্বর) ছিল এই মহিয়সী নারীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। সেই উপলক্ষে চ্যানেল-৭৮৬ এর মুখোমুখি হয়েছেন বড় ছেলে জাহিদ হোসেন। মায়ের বিভিন্ন স্মৃতি এবং কীভাবে তার জীবন গঠনে ভূমিকা রেখেছেন মা জোবেদা বেগম- সবিস্তারে সেসব বলেছেন...
প্রথমেই মা জোবেদা বেগমের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
সব সন্তানের কাছেই তার মা বিশেষ কিছু। তারপরও আমার মা জোবেদা বেগমের মতো নিষ্ঠা আমি আর কোনো মানুষের মধ্যে দেখতে পাইনি। সন্তানদের মানুষ করা এবং আত্মীয়-স্বজন আর প্রতিবেশীদের জন্য ভালো কিছু করাই যেন তার ব্রত ছিল। এটা এমনই নিষ্ঠার সঙ্গে করেছেন যে, নিজের জীবনের দিকে তাকানোর ফুসরৎ তার ছিল না। অন্যের মঙ্গলচিন্তাতেই তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন।
জোবেদা বেগমের জন্ম কত সালে?
১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে নেত্রকোণা জেলার সুষম দূর্গা গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন আমার মা জোবেদা বেগম। তার বাবা, মানে আমার নানা জাহেদ আলী ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। সেই সুবাদে ছোট বেলাতেই বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমার বাবার সঙ্গে মায়ের বিবাহ হয় ১৯৫১ সালে। যখন বিয়ে হয় তখন মায়ের বয়স বড়জোর ১০-১১ বছরের মতো হবে।
আপনার বড় হওয়ার পেছনে মায়ের ভূমিকা কতটুকু?
সবটুকুই। মাকে বাদ দিলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, সরকারি চাকরি শেষ করে অবসরে যাওয়া-এসব কিছুই হতো না। শুধু আমি কেন, আমার সকল ভাই-বোনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি আমাদেরকে সম্পূর্ণ আগলে রেখে মানুষ করেছেন। অনেক বড় পরিবার ছিল আমাদের, নিজের বিশ্রামের কথা ভেবে তিনি যদি একটু ছাড় দিতেন তাহলে হয়তো আমরা প্রতিষ্ঠিত হতে পারতাম না। বাবা ওসমান আলী অর্থের জোগান দিয়েছেন সত্য, কিন্তু তিনি যেহেতু সবসময় অফিসে থাকতেন, তাই আমাদের খোঁজখবর রাখতে পারতেন না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন মা জোবেদা বেগম।
তিনি খুব ধর্মাপরায়ণ ছিলেন বলে জানা যায়...
আমাদের পুরো পরিবারই আসলে ধর্মপরায়ণ। তবে বাবার জীবনের শুরুটা কিন্তু আর দশটা যুবকের মতোই হয়েছে। ধর্মের দিকে তার কনভার্ট হওয়ার ঘটনাটা কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে চাকরি করার সময়। তিনি কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মের বিধান পালন করতেন তার একটা উদাহরণ দিতে চাই। একদিন চাকরি থেকে ফিরে ঘরের বাইরে থাকা অবস্থায় মায়ের গলার আওয়াজ শুনলেন। কেন মায়ের গলার আওয়াজ বাইরে গেল, সেজন্য তিনি ১৫ দিন মায়ের হাতের রান্না খাননি। এই ছিল তার ধর্মচর্চা। মাও ঠিক তেমনই ছিলেন। ধর্মের বিধান পালনে চুল পরিমাণও ছাড় দিতে দেখিনি।
দানশীল হিসেবে কেমন ছিলেন জোবেদা বেগম?
আব্বার একার রোজগারে আমাদের পরিবারটা চলতো। ভাই-বোনরা সবাই পড়াশোনা করেছে। তাই দান করার আসলে সেই অর্থে কোনো সুযোগ ছিল না। তারপরও মা সাধ্য অনুযায়ী মানুষকে দান করতেন। নিজে ছেড়া কাপড় পড়েছেন, অথচ অন্যকে দানও করে গেছেন। মা যেন ঠিক নিজের জন্য কখনোই বেঁচে ছিলেন না। পুরো জীবনটাকে তিনি অন্যদের জন্য উৎসর্গ করেছেন। বাবার বাড়ির আত্মীয়রাও অনেক সময় বাবার কাছে চেয়ে মায়ের কাছে চাইতেন।
মায়ের কাছ থেকে শেখা কোন বিষয়টা এখনও কাজে লাগছে?
মায়ের কাছে তো অনেক কিছুই শিখেছি। তিনি বলতেন, সৎ থাকলে তাকে কেউ হারাতে পারে না। নিজের পুরো জীবনে আমি সেই কথা এপ্লাই করেছি। চেষ্টা করেছি সৎ থাকার। সেজন্যই হয়তো আল্লাহ আমাকে কোথায়ও আটকে দেননি। যতদিন বেঁচে আছি, মায়ের এই শিক্ষা নিয়েই বেঁচে থাকতে চাই।
কতটা অসাম্প্রদায়িক ছিলেন জোবেদা বেগম?
কাউকে কখনো ঘৃণা করেছেন তিনি, এমনটা দেখতে পাইনি। ধর্মের বিবেচনায় হোক কিংবা অন্যভাবে, মানুষে মানুষে বিভেদ করেননি তিনি। মা বলতেন, মানুষকে হিন্দু-মুসলমান দিয়ে বিচার করো না। মানুষকে মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। একদিনে তিনি নিজে কঠোর ধর্মচর্চা করতেন, অন্যদিকে ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিচার করতেন না।
তার নামে প্রতিষ্ঠা করা মাদরাসা সম্পর্কে জানতে চাই।
মায়ের মৃত্যুর আগেই মায়ের নামে এই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করে আমার ভাই মাওলানা আবদুল্লাহ। নেত্রকোণাতে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এখান থেকে প্রতিবছর এক ঝাঁক মেয়েশিশু ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে বের হচ্ছে। আমি মনে করি, তার একটা সাওয়াবের অংশ চলে যাচ্ছে আমার মায়ের কবরে। আমরা মায়ের নামের এই প্রতিষ্ঠানটিতে আরও ছড়িয়ে দিতে চাই। এখান থেকে বেরুনো ছোট্ট মেয়েশিশুরা সবাই একদিন আমার মায়ের মতো হবে, সেই স্বপ্ন দেখি।
কতটা অতিথিপরায়ন ছিলেন তিনি?
মেহমানদের খুব সম্মান করতেন মা। বাসায় যদি কোনো মেহমান আসতো, তাহলে সবচেয়ে উত্তম খাবারটা তাকে খাওয়াতেন। কখনো মেহমানের ওপর আমাদেরকে প্রাধান্য দিতে দেখিনি। আরেকটি বিষয় হলো- মেহমান মানে শুধু রক্তের সম্পর্কের কেউ কিংবা আত্মীয়-স্বজন হতে হবে- এমনটা মনে করতেন না তিনি। অপরিচিত একজন আগন্তুককেও তিনি মেহমান হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং সাধ্য অনুযায়ী তাকে খেতে দিতেন, সেবা করতেন।
আলহাজ জোবেদা বেগমের মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাই।
আমার মা মারা গেছেন ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। আমি যেটা সবসময় অনুভব করি, তা হলো- তার মৃত্যু মানে প্রস্থান নয়। আমরা ভাইবোনেরা এখনো তাকে ঘিরেই আবর্তিত হই। তিনি এমনভাবে ভালোবাসা দিয়ে আমাদেরকে তৈরি করে গেছেন, এত ভালো ভালো জিনিশ শিখিয়েছেন যে, সেগুলো নিয়েই আমরা বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারি।
চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পন্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।