যুদ্ধ-বিগ্রহ আর রাজনৈতিক সহিংসতার এই বাড়বাড়ন্ত সময়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দের নাম ‘শান্তি’। কিন্তু বাস্তবে এর দেখা মেলে খুব কমই। কেন পৃথিবীর শান্তির এত অভাব, এক্ষেত্রে মানুষেরইবা করণীয় কী—চ্যানেল৭৮৬ এর সঙ্গে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব জিজ্ঞাসার জবাব দিয়েছেন কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল হোসাইন।
অশান্তির মূল কারণ কী?
মানুষ আসলে নিজে ভালো থাকতে গিয়ে অন্যের ক্ষতি করে। এটা সভ্যতার শুরু থেকেই হয়ে আসছে। অথচ অন্যের ক্ষতি না করেও ভালো থাকা যায়, কিন্তু মানুষ সেটা করে না। ধরুন, একজন মনে করল, ভালো থাকতে হলে তার আরেকটু জমি দরকার, সেজন্য সে অন্যের জমির কিছু অংশ কেটে নিজের জমির মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। এটাই অশান্তির সূত্রপাত। অনেকে তো নিজেকে ভালো রাখতে গিয়ে অন্যকে অবলীলায় খুনও করে ফেলে।
সমাজে শান্তি ফিরবে কীভাবে?
আমরা সবাই শান্তিতে থাকতে চাই। মানুষ হিসেবে আমাদের মূল কাজটিই হলো, আমি ভালো থাকবো, একইসাথে আমার দ্বারা যাতে অন্য কারও কোনো ক্ষতি না হয়, সেটা খেয়াল রাখা। এই কাজটা ঠিকঠাক করতে পারলেই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এর একটি করলে কিন্তু হবে না। যেমন, আমি ভালো থাকার জন্য অন্যের ওপর জুলুম করলাম। তাহলে কখেনোই শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে না।
মানুষ কি অবচেতনে অন্যের ক্ষতি করতে পারে?
অবশ্যই পারে। তাই এ ব্যাপারে আমাদেরকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। পৃথিবীটা এখন গ্লোবাল ভিলেজ। আমরা একের অন্যের সঙ্গে ভীষণভাবে কানেক্টিং। বাংলাদেশের মানুষ যখন অফিসে কাজ করে, তখন আমেরিকার মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এখন বাংলাদেশে যদি ওই সময় বড় কোনো সংঘর্ষ হয়, তাহলে খবরটা চলে যাবে মুহূর্তেই। তাতে আমেরিকার মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। এটাও একটা অশান্তি। এখন আর মানুষের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই। ন্যানো সেকেন্ডর মধ্যে খবর পৌঁছে যায় পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে।
ইন্টারন্যাশনাল ডে অব পিস কবে চালু হলো?
মহাযুদ্ধগুলোর প্রেক্ষাপটে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা হলো। এরপর ১৯৪৮ সালে আমরা দেখলাম ‘ইউএন ডিকলারেশন অব হিউম্যান রাইটস’। এসবের ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে চালু হলো ইন্টারন্যাশনাল ডে অব পিস। অবশ্য একটা দিনের জন্য নয়, প্রতি মুহূর্তেই আমরা শান্তি চাই।
যুদ্ধ কি আসলে শান্তি আনতে পারে?
না। যদিও শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ চলছে। এই যে যুদ্ধগুলো হয়, বিশেষকরে দুটি বিশ্বযুদ্ধ হলো। এতে কিন্তু রক্তপাত ছাড়া আল্টিমেটলি কোনো লাভ হয় না, কোনো শান্তি হয় না। তবে যারা শান্তির ‘ব্যবসা’ করে, তারা একদিকে যুদ্ধ চালায়, আরেকদিকে শান্তির কথা বলে। তবে আমরা কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। আমরা সারাক্ষণই বলবো, আমরা শান্তি চাই।
উন্নত দেশগুলোতে সামরিক বাজেট বাড়ছে, এটা কীসের লক্ষণ?
এটা আরও অশান্তির লক্ষণ। পৃথিবীতে বর্তমানে দশটি দেশের এক বছরের সামরিক বাজেট দিয়ে জাতিসংঘ তার নিজের সাড়ে ৭০০ বছরের বাজেট সংকুলান করতে পারে। ভাবা যায়! এই মুহূর্তে প্রায় ৩ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত। যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে তারা নিজের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে এই মানুষগুলোর জন্য কিছু করা উচিত। এই পৃথিবীতে বর্তমানে এক বছরের সামরিক খাতে যে বাজেট হয়, তা দিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ একশ বছর খেতে পারে। পৃথিবীতে কিন্তু সম্পদের অভাব নেই, খাবারের অভাব নেই। কিন্তু মুশকিলটা হলো, যে খাতে এই সম্পদ বণ্টন করা দরকার ছিল, সেই খাতে বণ্টন করা হচ্ছে না।
যুদ্ধের প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী?
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে পৃথিবীর অনেক দেশ ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক-জড়িয়ে গেছে। এর প্রভাবে আমরা এখন ২০ টাকার জিনিশটা ৬০ টাকায় কিনে খাই। এই আধুনিক বিশ্বে যুদ্ধ এমন একটা জিনিশ, যার জন্য পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ কোনো না কোনোভাবে সাফার করে। দুঃখজনক হলো, বিশ্বের মোড়লরা এটা বুঝেও না বুঝার ভান করে। আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো, কোভিডের মতো একটা ভয়ংকর মহামারি আমাদেরকে কিছুই শিক্ষা দিতে পারেনি। যুদ্ধ লাগায় গুটিকয় শাসক, আর এর ফল ভোগ করে পুরো পৃথিবী।
শান্তিমতো বাঁচার অধিকার তো নিশ্চয়ই সবার আছে?
অবশ্যই। এটা কিন্তু ফিউডালিজমের যুগ নয়। এখন কোনো রাজা নেই যে, তিনি ইচ্ছে করলেন আর একটা শহর দখল করে নিলেন। ইচ্ছে করেলেন তো, কাউকে মেরে ফেললেন। এটা মানবাধিকারের যুগ। এই সময়ে একজন মানুষকেও আপনি বিনা হত্যা করতে পারেন না, করা উচিতও নয়। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে না। আমরা প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে শুনি, ইয়েমেনে এতজন মারা গেলেন, অমুক দেশে এতজনকে মেরে ফেলা হলো। এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে।
সব ধর্মই শান্তি চায়, অথচ ধর্মকে আশ্রয় করেই সন্ত্রাসী হামলা হয়…।
ধর্মের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যাটা হয় তাদেরকে নিয়ে যারা ধর্ম পালন করে। বিভিন্ন সময় ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ধর্মকে ব্যবহার করে অশান্তি সৃষ্টি করা হয়, তাতে ধর্মের কিন্তু কোনো দোষ নেই। দোষটা তার, যিনি ব্যবহার করছেন। ব্যক্তির কারণে ধর্মকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।
ইসলাম ধর্মের নাম নিয়েও সন্ত্রাস হয়…।
ইসলামের ক্ষেত্রেও কথাটা একই। ইসলামের নাম নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে সেই দোষটা ইসলামের নয়। ব্যক্তির বিচ্যুতি ঘটতেই পারে, তাতে ধর্মের কিছু যায়-আসে না। ইসলামকে জানতে হবে কোরআন-হাদিস দিয়ে। অনেক সময় আমরা কোনো ব্যক্তি দিয়ে আলোড়িত হই, হয়তো কোনো ওয়াজ দিয়ে আলোড়িত হই। এগুলো আমাদেরকে অনেক সময় ডাইভার্টেড করে ফেলে। ওয়াজ মাহফিল শোনায় কোনো সমস্যা নেই, তবে কোরআন-হাদিসও পড়তে হবে, জানতে হবে।
ইসলামে শান্তি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বড় উদাহরণ কোনটি?
শত শত উদাহরণ আছে। তবে আমার মনে হয়, মহানবীর (সা.) জীবন থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বড় ঘটনা তুলে নিয়ে আসা যায়। মক্কা থেকে কতটা নির্যাতিত হয়ে মহানবীকে (সা.) মদীনায় চলে যেতে হয়েছিল, সেটা কল্পনা করাও মুশকিল। এরপরও এক সময় তিনি যখন মক্কা বিজয় করলেন, সকল ক্ষমতা তার হাতে কেন্দ্রীভূত হলো, তখন সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন! প্রতিশোধের বদলে ভালোবাসা দিলেন। শান্তির এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন, যেটা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়বার ঘটেনি।
রাসূলও (সা.) তো যুদ্ধে জড়িয়েছেন?
সেগুলোর প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারপরও যুদ্ধগুলোতে রাসূল (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে পরিষ্কার বার্তা দিয়েছেন, নারীদের ওপর অত্যাচার করা যাবে না। বৃদ্ধদেরকে অত্যাচার করা যাবে না। খাদ্যশস্য ধ্বংস করা যাবে না। অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে আঘাত করা যাবে না।
ইসলামোফোবিয়া নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই…।
ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আছে গোটা বিশ্ব। এর পেছনে অনেক ম্যাকানিজম কাজ করে। মুসলমানরা ইনটেলেকচুয়াল লেভেলে অনেক পিছিয়ে, তাই তারা এগুলো ঠিকমতো মোকাবিলা করতে পারে না। ইসলামকে খারাপ ধর্ম হিসেবে প্রচার করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। খেয়াল করে দেখবেন, ইউরোপ-আমেরিকায় কোনো লোক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে বলা হয় তার মস্তিস্ক বিকৃত ছিল। আর ওই ব্যক্তি যদি মুসলমান হয়, তাহলে বলা হয় মুসলিম সন্ত্রাসী। বলা হয়, ইসলাম একটি খারাপ ধর্ম।
ইসলাম কি অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চায়?
অবশ্যই। ইসলাম যদি অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা না বলে থাকে, তাহলে মদিনায় রাসূলের (সা.) শাসনের সময় এত ইহুদী থাকে কীভাবে? মক্কা বিজয়ের পরও সেখানে এত অমুসলিম থাকে কীভাবে? সকল ক্ষমতা হাতের মুঠোয় থাকার পরও অমুসলিমদেরকে তো মক্কা থেকে বের করে দেওয়া হয়নি।
চ্যানেল৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ইমেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পণ্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।