শীতের সন্ধ্যা। সমুদ্রতীরবর্তী হাইওয়ে বেল্ট পার্কওয়ের রাস্তায় যানজটে জোনাকির আলোর মতো জ্বলছে গাড়ির লাইট, সেই ট্রাফিক ভেদ করে সেন্ট আলবান্স থেকে ওজনপার্কে যাচ্ছি। স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও সঙ্গে আরও দুই গুণীজন, সাপ্তাহিক ঠিকানার প্রধান সম্পাদক মুহম্মদ ফজলুর রহমান এবং নটরডেম কলেজের সাবেক অধ্যাপক হুসনে আরা বেগম ; উদ্দেশ্য, সদ্য কৈশোরউত্তীর্ণ একটি ছেলের জন্মদিন উদযাপনে অংশ নেওয়া।
এদেশে কন্যারা ষোল বছরে পা দিলে মা-বাবা এবং বন্ধু-স্বজনরা ‘সুইট সিক্সটিন’ পার্টি করে। ছেলেদের পার্টি হয় আঠারো বছরে পদার্পণের সময়। চলতি পথে কথা হচ্ছিল, আমরা তো একটি ছেলের ষোল বছর উদযাপন করতে যাচ্ছি , সেটাকেও কি আমরা সুইট সিক্সটিন বলবো? নাহ, এমনটা তো কাউকে বলতে শুনিনি। আমি বললাম ‘হ্যান্ডসাম সিক্সটিন হলে কেমন হয় ? কিন্তু সেটাতেও পুরোপুরি সমর্থন মেলেনি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো ‘সুপার সিক্সটিন’ বলবো। সুপার সিক্সটিনের নাম আলভান চৌধুরী। বাংলার গায়েনখ্যাত আলভানের জন্ম আমেরিকায়, পড়াশুনা আমেরিকায়। রাস্তায় বেরুলে শুনে রক কিংবা রেপ মিউজিক, কিন্তু সেগুলো তাকে টানে না, সে বাংলার গান গায়। রবীন্দ্র- নজরুল-লালন সব ধরণের গানই সে গায়। শুধু গায় বললে ভুল হবে, সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত তার অসাধারণ কন্ঠে সব ধরণের গানই আসে। এই দুরপ্রবাসে দেশের জন্য যখন মন হাহাকার করে, কিশোর আলভানের সুমধুর কন্ঠ আমাদের শুষ্ক হৃদয়ের পুষ্পবৃষ্টি ঝরায়। বহুজাতিক সংস্কৃতির এই দেশে পাশ্চাত্যের রক কিংবা অপেরা সঙ্গিতের সাথে বাংলার একতারার সমন্বয় ঘটাচ্ছে যে কয়েকজন সৃষ্টিশীল বাঙালি, দ্বিতীয় প্রজন্মের আলভান তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে।
আধাঘন্টার মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছালাম। সিনিয়র সিটিজেন সেন্টার অডিটোরিয়াম খুঁজে পেয়েছি আলভানের ছবি দেখেই, গেটের সামনেই বড় করে টানানো তার ছবি। মা আকলিমা রানা চৌধুরী, বাবা ডাক্তার শহিদুল ইসলাম পাখির চোখ করে রাখেন ছেলেটিকে। স্কুলে চাকরি করেন দু’জন, আমার স্ত্রীর সহকর্মী। আর আমার সঙ্গে সম্পর্ক মতিহার সবুজ চত্বরের টানে। সবকিছু ছাপিয়ে আলভানের গানের বড় ভক্ত আমরা। বলা যায় বিগ ফ্যান।
সন্ধ্যা ৭ টার মধ্যেই আমন্ত্রিত অতিথিদের পদচারণায় অডিটোরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই আলভানকে গানে গানে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস(বিপা) এবং আরটিভির বাংলার গায়েনে অংশ নেওয়া তার সহশিল্পীরা। নৃত্য পরিবেশন করে মুনজাবিন হাই ও নামিয়া আমিন। আলভানের সঙ্গে ডুয়েট পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন সঙ্গিত শিক্ষক সেলিমা আশরাফ, নীলুফার জাহান। তাদের পরিবেশনা ছিলো আলভানের জন্মদিনে শিক্ষকদের উপহার।
জন্মদিনের কেক কাটেন আলভানের সহশিল্পী ও বন্ধুরা। এ সময় মঞ্চে ছিলেন মা আকলিমা রানা চৌধুরী, বাবা ডাক্তার শহিদুল ইসলাম, আলভানের বোন, ভাগ্নিসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা।
জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলেন আরটিভি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিক রহমান, কো-অর্ডিনেটর অলিভ আহমেদ, ভয়েস অব আমেরিকায় নিউইয়র্ক প্রতিনিধি আকবর হায়দার কিরণ, সাংবাদিক দম্পতি হাসানুজ্জামান সাকী ও সাদিয়া খন্দকার, টিবিএন২৪ প্রতিনিধি শেখ সিরাজ, প্রবাসের জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী শাহ মাহবুব, মাসুদুর রহমান, সাহিত্য একাডেমীর পরিচালক মোশারফ হোসেন, শামস চৌধুরী রুশো, স্বনামধন্য চিকিৎসক দম্পতি মোস্তাফিজুর রহমান টিংকু ও নাজিফা বানু রিকু, ফটো সাংবাদিক নিহার সিদ্দিকী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মিনহাজ আহমেদ সাম্মু, ছড়াকার মৃদুল আহমেদ, শামীম সিদ্দিকী, এনওয়াইপিডি সদস্য একেএম মনিরুল হক রাহুল, একটিভিস্ট আহসান হাবীব, ফতেনূর আলম বাবু, বিধান পাল, ফ্যাশান মডেল নিলুফার যারীণ, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী মনিরা আকঞ্জি, সঙ্গিতশিল্পী নাফিসা নূর সাথী, নাজমা ইসলাম শিল্পী, ছন্দা রায়, জেরিন মাইশা, সাগ্নিক মজুমদার, সামিয়া ইসলাম, ফাবিয়া হোসেইন নিসা, সৌরভ কুমার মন্ডল, সৌভিত চৌধুরী সহ নিউইয়র্কের দুই শতাধিক পরিচিত মুখ।
সোনিয়া সিরাজের উপস্থাপনা, পিংক নয়েজের শব্দ প্রকৌশল, ‘মাসুদ এন্ড ফ্রেন্ডস মিউজিক’ এর বাদ্যযন্ত্র সহায়তায় আলভানের একক পরিবেশনা সকলকে মুগ্ধ করে। অনুষ্ঠানে আগত বিশিষ্টজনরা কথামালা আর করতালির মাধ্যেমে আলভানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছায় সিক্ত করেন। সকলের কন্ঠে আলভানকে ঘিরে প্রত্যাশা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাঁরা বলেন, সুপার সিক্সটিন আলভান চৌধুরী প্রবাসে বেড়ে ওঠা দ্বিতীয় প্রজন্মের গর্বিত প্রতিনিধি। ফ্রাংক সিনাট্রা স্কুল অব আর্ট এন্ড মিউজিকে অধ্যয়নরত ভোকাল মেজরের ছাত্র আলভান চৌধুরী ইতোমধ্যে কার্নেগি হল এবং জনপ্রিয় অপেরা হাউজে বাংলা সঙ্গিত পরিবেশন করে পাশ্চাত্যের সঙ্গিত জগতে পদার্পন করেছে, বহুদুর যাবে তার ইঙ্গিতও স্পষ্ট।
তবে, একটি কথা বলা প্রয়োজন। মা আকলিমা রানা চৌধুরীর কঠোর পরিশ্রম, বাবার সহায়তা এবং শিক্ষকদের পরিচর্যার ফসল হিসেবে আলভান অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছে সত্য, কিন্তু পরিপূর্ণ সাফল্যের জন্য যেতে হবে আরও অনেকদুর। মনে রাখতে হবে, ‘সে এখনও একটি ছোট্ট চারাগাছ, শেকড়গুলি মাটির উপর আলগা।’ —এজন্য প্রয়োজন নিবিড় পরিচর্যা। সঠিক পরিচর্যা পেলে এই চারাগাছটি একদিন মহিরুহে পরিণত হবে সন্দেহ নেই।
আসলাম আহমাদ খান
লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মী,
সাধারণ সম্পাদক,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন, ইউএসএ।