আধুনিকায়ন উন্নয়ন ধারণার সঙ্গে ব্যাপকভাবে যুক্ত তার বস্তুবাদী প্রকাশে, অন্যদিকে পশ্চিমীকরণ উন্নয়নশীল (অ-পাশ্চাত্য) দেশগুলোর সাংস্কৃতিক, পরিবার ও সম্প্রদায়গত মূল্যবোধের ওপর পশ্চিমা মূল্যবোধের সঙ্গে জড়িত। ফাফ (২০০২, পৃ.১) পশ্চিমীকরণের বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন এভাবে—‘পাশ্চাত্যবাদীদের কাছে পশ্চিমীকরণ মানেই অন্যান্য সমাজের লোকদের জন্য মুক্তি, পশ্চিমীকরণের প্রায়ই অর্থ ধ্বংস, সামাজিক এবং নৈতিক সংকট, যার সঙ্গে একটি পুনর্গঠিত এবং আক্ষরিকভাবে হতোদ্যম বিশ্বে ব্যক্তিদের অবতারণা ঘটে।’ আধুনিকীকরণের পক্ষের তাত্ত্বিকরা পশ্চিমা মানদণ্ডকে কঠোরভাবে ব্যবহার করে ‘আধুনিকতা’ সংজ্ঞায়িত করেন। উপরন্তু, আধুনিকীকরণ তত্ত্বগুলোর জন্য প্রসঙ্গের অন্তর্নিহিত কাঠামোটি হচ্ছে উন্নয়নের ‘পশ্চিমা মডেল’, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনুসরণের জন্য একমাত্র আদর্শ। পশ্চিমা মানসিকতায় নিমগ্ন এই সাধারণ বোঝার ওপর প্রতিফলন করে হলমস্ট্রোম (২০০২) সাধারণভাবে পশ্চিমা, তবে তার নিজস্ব নয়, ধারণা এভাবে তুলে ধরেন; যা ‘উন্নয়নের’ স্বরলিপি নিয়ে গঠিত।
‘উন্নয়ন বলতে বোঝায় আমাদের মতো হয়ে ওঠা, যার অর্থ আমরা যারা ধনী দেশে বাস করি, তাদের মতো হওয়া। দরিদ্র দেশগুলোর ধনী হওয়ার উপায় হচ্ছে তাদের আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুকরণ করতে হবে, যেমন মুক্ত বাজার চালু করা; আমাদের সংস্কৃতি, কার্যনীতি, ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি আত্মস্থ করা (হলমস্ট্রোম, ২০০২, পৃ. ৩৬-৩৭)।
হলমস্ট্রোম (২০০২) উন্নয়নের সাধারণ পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির বর্ণনা দিলেও শ্রেষ্ঠা (২০০০) তার ‘নিজস্ব উন্নয়নমূলক অভিজ্ঞতা এবং যাত্রা’ প্রতিভাত করেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার যৌবনের বছরগুলোয় পাশ্চাত্য মূল্যবোধ এবং উন্নয়নমূলক চিন্তাভাবনা দ্বারা তার ‘মন অধ্যুষিত’ করা হয়েছিল এভাবে—
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যদিও আমি পুরো বৃত্তে এসেছি। আমি পাশ্চাত্য উন্নয়নের উৎসাহী গ্রাহক নই, যা একসময় ছিলাম। আমি যতই পর্যবেক্ষণ করছি নেপালের মতো দেশগুলোয় যা ঘটছে, বিশেষত তাদের উদীয়মান উন্নয়নের উদ্যোগের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি, যা পশ্চিমা বস্তুবাদে গভীরভাবে প্রোথিত, ততই আমি এর মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলি (শ্রেষ্ঠা ২০০০, পৃ. ১১১-১১২)।
ইসলাম ও আধুনিকতার মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি এবং পরবর্তী সময়ে উন্নয়নের পথে এ-জাতীয় সম্পর্কের প্রভাব নিয়ে যে বিতর্ক, তা সহসা শেষ হওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই। ইসলাম ও আধুনিকীকরণের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে দুটি বিপরীতমুখী চিন্তাধারা (ধী-গোষ্ঠী)। প্রথম গোষ্ঠী দাবি করেছে যে ইসলাম একটি স্থিতিশীল ধর্ম, যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উদ্ভাবনের পথে সহায়ক নয় এবং মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ উদ্যোক্তা উত্থানের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের ক্ষেত্রে বাধা (কুলসন, ১৯৬৪; ল্যাবহোম, ২০০৩; পারকিনস, ২০০৩; পাইপস, ১৯৮৩)।
এ চিন্তাধারার ধারকরা বিশ্বাস করেন যে অ-পশ্চিমা সংস্কৃতি আধুনিকায়নের সঙ্গে বেমানান এবং এ-জাতীয় সমাজের বিকাশের জন্য তাদের আধুনিক হতে হবে, আধুনিকীকরণের জন্য তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে এবং পশ্চিমা আধুনিকতার দিকে সাংস্কৃতিক রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এভাবে তারা পশ্চিমীকরণের সঙ্গে আধুনিকীকরণকে সমান গণ্য করে এবং তারা এ অনুমানের অধীনে কাজ করে যে সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যবোধ এবং অ-পাশ্চাত্য সমাজের ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে পাশ্চাত্য সম্প্রদায়ের একটি সংঘর্ষ বিদ্যমান। তারা আরো মনে করে যে বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রমাণের ভিত্তিতে অ-পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি থেকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের কারণে প্রথাগত সমাজের উন্নয়ন করতে হলে পশ্চিমা পথে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
সুতরাং সমস্যাটি স্বয়ং আধুনিকীকরণের নয় এবং আধুনিকীকরণ করা হবে কি হবে না; বরং এটি কিছু লোকের সনির্বন্ধতার মধ্যে নিহিত, যারা বলে যে আধুনিকীকরণের জন্য পশ্চিমীকরণ অপরিহার্য। বার্গার (১৯৯১) এবং লি ও পিটারসন (২০০০) সাংস্কৃতিক রূপান্তরের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু পাইপস (১৯৮৩) আধুনিকতাকে ইসলামের আলোকে ব্যাখ্যা এবং তার মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে আরো স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ এবং সংঘাতমূলক হতে পারেননি। ‘ইসলাম আধুনিকীকরণের বিকল্প উপায় দিতে পারেনি...মুসলমানরা তখনই প্রযুক্তিগত এবং পরবর্তী সময়ে উন্নয়নের পথে থাকতে পারবে যখন তারা স্পষ্টভাবে পশ্চিমা মডেল গ্রহণ করবে (পাইপস, ১৯৮৩, পৃ. ১৯৭-১৯৮)।’ আরব মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০০২-০৩-এর মূল্যায়নে ল্যাবহাম (২০০৩) উল্লেখ করেছেন, প্রতিবেদনটি ‘অর্থনৈতিকভাবে অব্যাহত থাকার অবিচ্ছিন্নতার ওপর ইসলামের প্রভাবের সূক্ষ্ম প্রশ্ন থেকে দূরে রয়েছে।’ এ মনোভাব সাধারণ পশ্চিমা ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ যে ইসলাম এবং উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্কটি আপাতবিরোধী।
লার্নারকে (১৯৫৮) বলা যেতে পারে সাংস্কৃতিক রূপান্তর ও পশ্চিমীকরণের সঙ্গে আধুনিকীকরণের সমীকরণের প্রথম দিকের প্রবক্তা। ছোট তুর্কি বালগাট গ্রামের আধুনিকীকরণের ওপর তার গবেষণায় লার্নার আধুনিকীকরণ ও পাশ্চাত্যকরণের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হন। তিনি অতীতের হতাশা এবং ভবিষ্যতের আশার মধ্যকার চাপা উত্তেজনাকে এভাবে চিত্রিত করেন: একদিকে অতীত, পশ্চাত্পদতা এবং স্থিতাবস্থা; যা ‘প্রধানের’ ব্যক্তিত্বতে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। অন্যদিকে তার পুত্ররা গতিশীলতা, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভবিষ্যৎ এবং আরো ভালো আগামীর স্বপ্নের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। প্রধানের পুত্ররা সুযোগটি বুঝতে পেরে তা গ্রহণে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ত্যাগ করেছেন। তারাই এখন নব্য বিপণির রক্ষক, তারাই উদ্যোক্তা। এটি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে বৈপরীত্য (স্কেচ ও হ্যাগিস, ২০০২), যেখানে আধুনিকতা বিরাজ করছে। আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়াটি একবার শুরু হয়ে গেলে চিরাচরিত সমাজের সাংস্কৃতিক রূপান্তর ধীরে ধীরে না হয়ে দ্রুত হয়ে থাকে।
‘বালগাত’-এর সামাজিক বুনন, গ্রামবাসীর মূল্যবোধ এবং তাদের একাত্মতার অনুভূতির ওপর সাংস্কৃতিক রূপান্তরের প্রভাব ছিল না। অতএব, এটা অবাস্তব গণ্য করা হয়েছিল এবং লার্নারের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি। আধুনিকীকরণের কাজ বালগাটে চলছিল, লার্নার এমনটাই ঘোষণা করেন। অতএব, গবেষণাটি সম্পূর্ণ হয়েছিল এবং এর পরে যা ঘটেছিল তা প্রক্রিয়াটির অংশ হিসেবে গৃহীত হবে। সুতরাং লার্নার যা বলতে চাইছেন তা হচ্ছে, সংস্কৃতিগুলো একত্র হবে এবং রূপান্তরটি শেষ পর্যন্ত আধুনিক পশ্চিমা মূল্যবোধের দিকে চলে যাবে। কারণ এ যুক্তি অনুসারে, কেউ পশ্চিমা আধুনিকীকরণকে (রূপ) মূল্যবোধ ব্যবস্থার (বিষয়বস্তু) থেকে আলাদা করতে পারে না, যা পশ্চিমা বস্তুগত আধুনিকতাকে উসকে দেয়।
ড. এম কবির হাসান: অধ্যাপক, ফাইন্যান্স বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়িন্স
চ্যানেল ৭৮৬ এর নিউজ রুম এ যোগাযোগ করতে ই মেইল করুন এই ঠিকানায় [email protected] । আপনার পন্য বা সেবার প্রচারে বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কল করুন +1 (718) 355-9232 এই নাম্বারে।