ইহ ও পরকালীন মুক্তির জন্য যুগে যুগে নবি ও রাসুলগণের আগমন ঘটেছিল এই ধরাধামে। রাসুল (সা:) আসার মধ্য দিয়ে নবি-রাসুল আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন প্রচারে ও পথহারা মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে নবিদের উত্তারাধীকার আওলিয়ায়ে কেরামগণ যুগে যুগে আগমন করবেন। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে পীর, আওলিয়া ও উলামা মাশায়েখের মাধ্যমে।
যারা রাসুল (সা.)-এর অনুপম আদর্শ ও সুন্দরতম আখলাক নিজেদের মধ্যে লালন করতেন। মানুষের কল্যাণে একনিষ্ঠভাবে কাজ করতেন। সমাজ ও মানবতার কল্যাণে নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিতেন। তাঁহাদের মধ্যে সুদূর ইয়েমেন থেকে শাহজালাল ইয়ামনী (রহ.) ইসলাম প্রচারে আসলেন সিলেট। তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির বলেই জাহেলিয়্যাত পরাজিত হয়।
তাঁর পবিত্র পদধুলি পেয়ে সিলেট হয়ে গেল আধ্যাত্মিক রাজধানী। সিলেটের মাটিতে শাহজালাল (রহ.) স্বর্ণযংগের এসব ওলি-দরবেশের মধ্যে স্বার্থক একটি উজ্জ্বল নিদর্শন ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারী জামানার শ্রেষ্ট মুজাদ্দিদ, শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী (রহ.) অন্যতম।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ১৯১৩ সালে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বাদেদেওরাইল পরগণার ঐতিহ্যবাহী ফুলতলী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মুফতি আব্দুল মজিদ (রহ.)’র ও সুযোগ্য সন্তান আল্লামা ফুলতলী (রহ.) ছিলেন একজন ইনসানে কামিল। তিনি যেমনি ইসলামের একজন সফল খাদেম ছিলেন তেমনি সমাজ সংস্কারক ও মানবতাবাদি ছিলেন। আধ্যাত্মিক চিন্তাচেতনা বিকাশের কর্ণধার, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দিশারী ছিলেন।
তাঁর সুদীর্ঘ জীবন দ্বীনী খিদমতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন, মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত দ্বীন ইসলামের খিদমত আনজাম দিয়ে গেছেন, তাঁর দ্বীনী খিদমত এই পৃথিবীতে বিরল, তিনি তাঁর গোটা জীবন কুরআনের তরে উৎসর্গ করেছেন। দ্বীনী খেদমতের পরিধি বাংলাদেশ, ভারত তথা সমগ্র উমহাদেশ ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ইসলামি শিক্ষার প্রচার ও রক্ষায় মুসলিম কমিউনিটিকে উৎসাহিত দানসহ বহু দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্টান প্রতিষ্টা করেন এবং বৃটিশ সরকারের কাছেও এ বিষয়ে দাবি উত্থাপন করেন। যিনি এমনি এক ব্যক্তিত্ব যার প্রকৃতি থেকে অর্জিত শাশ্বত সত্যের উপলব্ধি থেকে সুন্দর ও শান্তিময় ইসলামি সমাজ গঠনে সমগ্র জীবনভর নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এ সকল মহৎ প্রাণ ব্যক্তিগণ মানুষের মাঝে বেঁচে থাকেন যুগ যুগান্তর।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.)-এর ধর্মীয় চেতনায় শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও ইসলামী সংস্কৃতি চর্চায় সুফিবাদী চিন্তা চেতনার প্রকাশ ও প্রচার ঘটেছে উনার হাতে বিস্তর। তিনি আমাদের সমাজ ও জাতীয় জীবনে এমন একজন ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভা, যিনি ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা, সাহিত্য, সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রনীতি, নৈতিকতা, জীবন ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও ইসলামি জ্ঞান এবং কোরআনের শিক্ষা বিস্তার ছাড়াও সাধনার প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিলেন এক পূর্ণমহিরূহ ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
এরমধ্যে লক্ষ্যণীয় তাঁর সমাজকর্ম। অন্য অনেক পীরের মতো তিনি দরবার স্থাপন করে অর্থ ও ক্ষমতা নিয়ে বসে থাকার পথ ধরেন নি। তিনি তাঁর সকল অর্জনকে মানবতার সেবায় বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রভাব তিনি কাজে লাগিয়েছেন কোরআন প্রচারে। দ্বীনী শিক্ষার প্রসারে। তাঁর সরলতার নমুনা এখনো দেখা যায় তাঁর উত্তরসূরী আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলীর মধ্যে। তাঁর অন্যান্য সন্তানদের মাঝেও তিনির দুনিয়া বিরাগী খেদমতের মানসিকতা।
বর্তমান যুগে একজন প্রভাবশালী ও পুরনো আমল থেকে বহু সম্পদশালী একজন পীর এতোটা দুনিয়াবিমুখ হতে পারেন তা বর্তমান পীরসাহেব আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরীকে না দেখলে বুঝা যাবেনা। মনে হবে তিনি একজন আল্লাহর ধ্যানে সদা নিমজ্জিত ব্যক্তি। শুধু বিদেশে নয় দেশেও আদর্শ শিক্ষিত ও আদব কায়দা সংবলিত আলোকিত ঈমানদার যোগ্য, দক্ষ মানুষ তৈরির জন্য ফুলতলীর প্রয়াস প্রশংসনীয়।
দুনিয়া যখন অর্থবিত্ত, ক্ষমতা ও ভোগবিলাসের পেছনে ছুটছে, বহু খান্দানী পীর আউলিয়া ও খানকাহ দরবার পরিচালকদেরও পদস্খলন ঘটছে। তখন ফুলতলীর নীতি আদর্শ চোখে পড়ার মতো। ৯৫ বছরের সুদীর্ঘ জীবনে তাঁর বহুমুখী প্রতিভা, সৃজনশীল কর্মদক্ষতা, পরমতসহিঞ্চুতা, ধর্মীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গি, মানবীয় ব্যক্তিত্ব এবং সর্বোপরি তাঁর সহজ-সরল অনাড়ম্বর, নিরহংকার ও নির্লোভ ধর্মীয় জীবন সাধনায় তাকে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণে সহায়তা করেছে।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.)-এর জীবন শুধু জ্ঞান সাধনায়ই ভাস্বর ছিল না, কর্মসাধনায়ও ছিল সদা তৎপর। যার আপাদমস্তক ছিল রাসুল (সাঃ)-এর আদর্শে উদ্ভাসিত। নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত এবং মজলুম মানুষের পক্ষে সু-উচ্চ কন্ঠস্বর। তিনি ছিলেন জালিম ও রাসুল (সাঃ)-এর শত্রুদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর ঐতিহাসিক সাক্ষ্যপুরুষ।
তিনি আমাদের সুদীর্ঘ গৌরবময় ধর্মীয় ও জাতীয় ঐতিহ্যের সত্যান্বেষী কালজয়ী ব্যক্তিত্ব। এ দেশে ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠায় সর্বমহলে অর্জন করেছেন ঈর্ষণীয় খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা। দ্বীনী খেদমতের পাশাপাশি সমাজসেবায় তাঁর অবদান অতুলনীয়। সারা জীবন সৃষ্টির খেদমত করে গেছেন। আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত প্রতিষ্ঠান এতিমদের লালন পালনের জন্য করে গেছেন এতিমখানা।
বর্তমানে তাঁর এতিমখানায় সহস্রাধিক এতিম রয়েছেন। তিনি বিনামূল্যে চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্টা করে গেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় লঙ্গরখানা বিধবা আতুর পুনর্বাসন কেন্দ্র ও গৃহ নির্মাণ, টিউবওয়েল স্থাপন ও বৃক্ষরোপনসহ নানা প্রকল্প স্থাপন করেছেন। যা আজও মানব সেবায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.) রাসুল (সাঃ)-এর আদর্শের প্রশ্নেও তিনি ছিলেন সারা জীবন অটল অবিচল। মুসলিম উম্মাহর মাঝে স¤প্রীতি এবং সৌহার্দ বজায় রাখতে তাঁর সাহসী ভুমিকা ছিল অনবদ্য। স্থানীয় এবং জাতীয় বিভিন্ন ইস্যুসহ প্রতিটি দুর্যোগপূর্ণ মুহুর্তে তিনি কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষ সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। তখন তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে জাতির বিবেক।
যখনই ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর আঘাত এসেছে, তখনই তিনি প্রতিবাদ করেছেন। প্রয়োজনে গড়ে তুলেছেন তীব্র গণআন্দোলন। জীবনের শেষদিকে বয়োবৃদ্ধ অবস্থায়ও দেশের মাদরাসা শিক্ষা ধ্বংসের অপকৌশলের বিরুদ্ধে, ফাজিলকে ডিগ্রি ও কামিলকে মাস্টার্সের মান প্রদান এবং স্বতন্ত্র ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সিলেট থেকে সহস্রাধিক গাড়ি বহর নিয়ে তিনি এক ব্যতিক্রমধর্মী লংমার্চ পরিচালনা করেন। অনেক ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েও তিনি সাহিত্য সাধনায়ও নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
তাফসীর, কিরাত, সীরাত, তাসাউফ ও কাব্য বিষয়ে বহু সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। এ কিতাবগুলো বহুল প্রচারিত ও পাঠক সমাদৃত। ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে বাংলাদেশ, লন্ডন, আমেরিকা ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অসংখ্য সংগঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.)-এর ইন্তেকাল বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ১৫ জানুয়ারি ঈসালে সাওয়াব মাহফিল পালন করা হয়। দেশ বিদেশের উলামায়ে কেরাম পীর মাশায়েখ ও চিন্তাবিদগণ মাহফিলে বয়ান পেশ করেন। বাঁধ ভাঙ্গা জনস্রোতে ‘বালাই হাওর’ যেন পরিপূর্ণ হয়। লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উপস্থিতিতে এ অঞ্চলের ইসলাম প্রিয়দের বিশাল এক মিলন মেলা বসে।
প্রতি বছর ১৫ জানুয়ারি ‘বালাই হাওর’ নতুন সাজে সজ্জিত হয়, আলোকিত হয়। একজন প্রকৃত আলেমের মৃত্যু একটি জাহানের মৃত্যুর সমান। স্মৃতিতে অম্লান আল্লামা ফুলতলী (রহ.) আজ শুধু একটি ব্যক্তিত্বের নাম নয়, একটি সংকল্পের, একটি সংগ্রামের নাম।