'বইটি' আত্মতুষ্টিমূলক, ভুল বা মিথ্যা তথ্যপূর্ণ, বিভ্রান্তিকর দাবী ভিত্তিক, ইসলামী ব্যাংকিং জ্ঞান বিবর্জিত একটি অতি নিম্নমানের লেখা। এই ধরণের লেখা 'বই' আকারে প্রকাশিত হতে পারা ও অতি বৃহৎ সংখ্যক পাঠক সমর্থন পাওয়া, সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের প্রকাশনী বাজার ও পাঠক মানের একটি হতাশাজনক অবস্থা প্রকাশ করে।
'বইটিতে' এত এত ত্রুটি আছে, যা আমার পক্ষে পূর্ণ আলোচনা করা সম্ভব নয়। শুধু কিছু উদাহরণ দিচ্ছি।
লেখকের আত্মতুষ্টির কিছু উদাহরণ:
নিজের লেখা সম্পর্কেই লেখক নিচের কথাগুলো বলেছেন 'বইটিতে':
- 'এই বইতে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি উঠে এসেছে যে আলোচনাটি শেষ করার জন্য বেঁচে থাকার বাড়তি প্রেরণা অনুভব করছি।'
- 'একটি জ্বালাময়ী লেখা'
- 'ইসলামি ব্যাংকব্যবস্থার সমস্যাগুলো নিয়ে এত গভীর বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ আগে কখনো দেখিনি'
- 'এই সবকিছু আল্লাহরই পরিকল্পনা ছিল'
- 'আল্লাহ আমার মতো পাপী বান্দাকে যে মানুষের সামনে সত্যকে উন্মোচন করার জন্য বাছাই করেছেন তার জন্য তার দরবারে হাজারো ধন্যবাদ'
ভুল বা মিথ্যা তথ্যের উদাহরণ:
পৃষ্ঠা ৩১-এ তিনি নেদারল্যান্ডস 'উদারমনা আলেমদের' অনুমোদনে 'হালাল পতিতালয়' খোলার কথা বলেছেন। অথচ, এটি একটি ভুয়া সংবাদ ছিল।
বিভ্রান্তিকর দাবীর উদাহরণ:
'লেখকের কথা' পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন 'প্রয়োজনীয়' শরিয়াহ আইন অধ্যয়ন করেছেন। কিন্তু, নিচে দেয়া 'মুরাবাহা' উদাহরণ থেকে দেখা যাবে যে তিনি সাধারণ ইসলামিক ফিনান্স চুক্তি সম্পর্কে জানেন না। একই অবস্থা অন্যান্য জায়গায়ও।
একই পৃষ্ঠায় তিনি দাবী করেছেন যে তিনি 'কুরআন, হাদিস ও আওফির নীতিমালা' উল্লেখ করে 'সব খুলে খুলে বর্ণনা' করেছেন। অথচ পুরো 'বইতে' মোট তিনটি হাদিস, তিনটি কোরআনের আয়ত, ও আওয়াফীর একটি রেফারেন্স দিয়েছেন, যার প্রাসঙ্গিকতাও প্রশ্ন সাপেক্ষ।
একই পৃষ্ঠায় তিনি বলেছেন, 'একটা বা দুইটা নয়, ততোধিক শরিয়া ব্যক্তিত্ব, ইসলামি অর্থনীতিবিদ এবং এই সেক্টরে কর্মরত ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা করেই বইটি লেখা হয়েছে। অথচ, তার সাথে কথা বলেছেন অন্তত তিনজন তার থেকে দূরত্ব প্রকাশ করেছেন। তিনি অনুমতি ছাড়া একজনের ছবি শেয়ার করেছিলেন, যা আপত্তির পর সরিয়ে ফেলেছিলেন। একটি প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়েছিলেন, যেটিও আপত্তির পর সরিয়ে ফেলেছিলেন।
অতি সাধারণ ইসলামী ব্যাংকিং জ্ঞানের অনুপস্থিতির উদাহরণ:
৯০-৯১ পৃষ্ঠায় তিনি মুরাবাহার নিম্নোক্ত বর্ণনা দিয়েছেন, যেখানে ভুলটি কি তা অতি প্রাথমিক পর্যায়ের ইসলামিক ফিনান্স ছাত্রও জানবে।
"মুরাবাহা এক ধরনের ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি। এই চুক্তিতে একজন ক্রেতা যখন বিক্রেতার থেকে পণ্য কিনেন তখন তিনি (ক্রেতা) পণ্যের ক্রয়মূল্য এবং আনুষঙ্গিক খরচের সমান টাকা পরিশোধ করেন।
উদাহরণ
মনে করুন আমি চীন থেকে একটি খেলনা কিনব। সেই খেলনার দাম ৫০০ টাকা। কিন্তু আমি চীনে থাকি না । আপনি আমাকে বললেন, “আমার পরিচিত একজন লোক আছে যিনি চীনে থাকেন। আমি তাকে দিয়ে আপনার জন্য চীন থেকে খেলনাটা আনিয়ে দিব। আপনি আমাকে ১০০ টাকা বাড়তি দিয়েন।” অর্থাৎ, ৬০০ টাকা দিয়ে আমি খেলনাটা কিনতে পারব। ৫০০ টাকা হচ্ছে খেলনার দাম এবং ১০০ টাকা হচ্ছে খরচ।
আবার মনে করুন, রংপুরে একটি গরুর দাম ১ লক্ষ টাকা। আপনি আমার জন্য রংপুর থেকে শেরপুরে গরুটি এনে দিবেন ১০ হাজার টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। এই চুক্তিও মুরাবাহা ।
এই ধরনের চুক্তি সম্পূর্ণ বৈধ এবং ন্যায্য। কিন্তু কেউ যদি কাজের ছুতো ধরে খরচ বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে তাহলে চুক্তিটি ন্যায্যতা হারিয়ে ফেলবে। যেমন কোনো ব্যক্তি বাজারে আপনার সামনে ১ লক্ষ টাকায় একটি গরু কিনে সাথে সাথেই যদি আপনার হাতে গরু তুলে দিয়ে বলে এর দাম ২ লক্ষ টাকা (১ লক্ষ টাকা প্রকৃত দাম এবং ১ লক্ষ টাকা খরচ), তাহলে আপনি নিশ্চয়ই মেনে নিবেন না। কারণ এই ক্ষেত্রে কোনো পরিশ্রম ছাড়াই অন্যায্য পারিশ্রমিক দাবি করা হয়েছে।"
(এটিকে 'বই' বলার ক্ষেত্রে আমি উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করেছি, কারণ আমি এটিকে বইয়ের মর্যাদা দিতে ইচ্ছুক নই।)
লিখেছেন: মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ এমআইবিএফ, সিআইপিএ, সিএসএএ, রিসার্চার ইন ইসরা রিসার্চ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার, ইনসিফ ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া